julymassacrearchive.org

শহিদ সাজ্জাদ হোসেন

শিক্ষার্থী,

সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়

মৃত্যুর স্থান: সাভার বাসস্ট্যাণ্ড

মৃত্যুর তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪

প্রতিবেদন: ভূবন চন্দ্র রায়

‘ডাক্তার বলছিল পাঁচ ব্যাগ রক্ত লাগবে। ওর রক্তের গ্রুপ জানা আছে? জানতে চাইলো ডাক্তার। আমি কথা বলার আগেই ছেলে অক্সিজেন লাগা অবস্থায় বললো, বি পজেটিভ (রক্তের গ্রুপ)। লাস্ট (শেষ) এই কথাটা ছেলের মুখ থেকে শুনেছি। ছেলেকে হারিয়ে এখন আমি নিঃস্ব এবং দিশেহারা।’ 

কথাগুলো শহিদ সাজ্জাদ হোসেনের বাবা মো. আলমগীর হোসেনের।

গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা। সারা দেশের মতো সেদিন ঢাকার সাভারেও ছিল জনতার ঢল।

সেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সপ্তম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন (২৫)। কথা ছিল বিজয় নিয়েই ফিরবেন ঘরে। সেদিন ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছে ঠিকই, সাজ্জাদ হোসেন ঘরে ফিরেছেন নিথর দেহে।

শহিদ সাজ্জাদ হোসেনের বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বাঙ্গালীপুর ইউনিয়নের লক্ষণপুর পাঠানপাড়া গ্রামে। সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশপাশি কাজ করতেন একটি পোশাক কারখানায়। এজন্য বাবা মো. আলমগীর হোসেন (৬০) ও মা সাহিদা বেগম (৫৫) ও নববিবাহিত (সাত মাস আগে বিয়ে) স্ত্রী সুমি আক্তারকে (২২) নিয়ে থাকতেন ঢাকার সাভার ডেইরী ফার্ম এলাকার দক্ষিণ কালমা গ্রামে। এক ভাই এবং তিন বোনের মধ্যে সাজ্জাদ হোসেন ছিলেন সবার বড়। বিয়ে হয়েছে বোন আশা এবং আনিকার। সবার ছোট বোন নিশাদ রয়েছেন পরিবারে। বাবা  মো. আলমগীর হোসেন সাভারে একটি মসজিদে নামাজ পড়ান।

পারিবারিক সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট মিছিলে সাজ্জাদ ছিলেন সবার আগে। এরপর বেলা ১১টার দিকে সাভার বাসস্ট্যাণ্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। আহত অবস্থায় সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৬ আগস্ট বেলা ২টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। ৭ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে সৈয়দপুর হাতিখানা কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয় তার। 

সেদিনের কথা বলতে গিয়ে সাজ্জাদ হোসেনের বাবা মো. আলমগীর হোসেন বলেন,‘মিছিলে যাওয়ার কথা বলে সকাল সাতটায় বাসা থেকে বের হয় সাজ্জাদ। এ সময় সে তার স্ত্রীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড চেয়েছিল। বৌমা (সাজ্জাদের স্ত্রী) কার্ড (আইডি কার্ড) দিতে অস্বীকৃতি জানালে দুইজনের (স্বামী-স্ত্রী) মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। সকাল ১০টায় আমি তাকে ফোন দিয়ে মিছিলের সামনে থাকতে মানা করি। এ সময় বলেছিল, আমার জন্য টেনশন করা লাগবে না’। 

তিনি বলেন, ‘এরপর মসজিদে নামাজ কালাম পড়ে দেড়টার পর থেকে দুইটা পর্যন্ত ফোন দিয়েছি, ওর ফোন বন্ধ পাইছি। তখন আমি সাভারের দিকে যাওয়ার সময় সিএমবি রোডে গিয়ে জানতে পারি সাজ্জাদ গুলিতে আহত হয়ে এনাম মেডিকেলে আছে। সেখানে গিয়ে ওকে অক্সিজেন লাগা অবস্থায় দেখতে পাই। ডাক্তার বলছিল পাঁচ ব্যাগ রক্ত লাগবে। আমি কিছু বলার আগে অক্সিজেন লাগা অবস্থায় ছেলে বললো বি পজেটিভ (রক্তের গ্রুপ)। লাস্ট এই কথাটা ওর মুখ থেকে শুনেছি। পরদিন (৬ আগস্ট) বেলা ১২টার পর মৃত ঘোষণা করা হয় তাকে’।

ছেলে হারানোর বেদনায় তিনি বলেন, ‘একমাত্র ছেলেই ছিল আমার সম্বল। ছেলেকে হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব। আমার বয়স হয়েছে, তেমন কিছু করতে পারি না। ছেলে লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন চাকুির করতো। আমি মসজিদে নামাজ পড়িয়ে সামান্য হাদিয়া পাই তাতে কোনভাবে চলতো সংসার। এখন ছেলেও নাই, আমার থাকার মত তেমন আশ্রয়ও নাই।

দেশের সরকারের কাছে আমার পরিবারের একটা আশ্রয় আর কর্মসংস্থান চাই।

তিনি জানান, সাতমাস আগে বিয়ে হয়েছে ছেলের। তার স্ত্রী সুমি আক্তার চাকুির করতো একটি পোশাক কারখানায়। ছেলের মৃত্যুর পর চাকুরিতে আর যায়নি বৌমা।

সাজ্জাদের স্ত্রী সুমি আক্তার মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন,‘সাজ্জাদকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। ও সবসময় বলতো আমাদের ঘরে সুখ একদিন ফিরবেই। কিন্তু এতো কম সময়ে  সে স্বপ্ন নিভে যাবে কখনো ভাবতে পারিনি’। 

প্রতিবেশী এবং সৈয়দপুর উপজেলার বাঙ্গালীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান খাঁন বলেন, ‘সাজ্জাদ ছিল তার বাবা মায়ের একমাত্র ভরসা। এখন ছেলেকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে পরিবারটি।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top