শিক্ষার্থী
নয়ামাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নারায়নগঞ্জ
১৯ জুলাই, ২০২৪

লেখা: আবু সাউদ মাসুদ
কোটা সংস্কার দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কনিষ্ঠ এক শহীদ রিয়া গোপ। মাত্র ৬ বছর বয়সি শিশুটি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। ১৯ জুলাই দুপুরের পর থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিআইটি এলাকায় আন্দোলনকারী ও পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছিল।
পরিস্থিতি দেখার জন্য পরিবারের সদস্যরা ছাদে যান। সঙ্গে যায় শিশু রিয়াও। কিছুটা সময় দেখে পরিবারের অন্যরা দুপুরের খাবারের জন্য বাসায় চলে আসেন। এর মধ্যে রিয়া খাবার খেয়ে আবারও ছাদে যায় খেলতে। ঘরের বাইরে তার খেলার জায়গা বলতে ছিল কেবল বাড়ির খোলা ছাদ।
প্রতিদিনের মতো ওই দুপুরে আবারও ছাদে যায় রিয়া। সেখানে সে খেলা করছিল। কিন্তু হঠাৎ ভবনের নিচে ও চার পাশে হৈচৈ, চিৎকার-চেঁচামেচি আর গুলির শব্দ। এসব শুনে দীপক কুমার গোপ দৌড়ে ছাদে যান মেয়েকে ঘরে আনতে। মেয়েকে কোলে তুলে নিতেই বুলেট এসে রিয়ার মাথায় বিদ্ধ হয়। মুহূর্তেই সে ঢলে পড়ে বাবার কোলে। রক্তে ভিজে যায় বাবা দীপকের শরীর। তাকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে নেওয়ার পর অবস্থার অবনতি দেখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন চিকিৎসক।
সেখানে রাতেই মাথায় সফল অস্ত্রোপচার হয়। রিয়াকে রাখা হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। বলা হয়, ৭২ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাবে না। অস্ত্রোপচারের পর শনিবার পার হয়। এরপর রোববার ও সোমবার আইসিইউতে একটু একটু করে আঙুল নাড়ছিল রিয়া। স্বজনদের বুকে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু ২৪ জুলাই সকালের দিকে সেই নড়াচড়াটুকুও থেমে যায়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে পরপারে পাড়ি জমায় রিয়া গোপ।
রিয়ার লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয় বুধবার সন্ধ্যায়। মর্গ থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার আগে স্ট্রেচারে রাখা মেয়েটির মুখ দেখানো হয় স্বজনদের। মুহূর্তেই কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। ঢামেকে রিয়ার মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয় ‘গানশট ইনজুরি’।
রিয়া স্থানীয় নয়ামাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। ২৪ জুলাই রাতেই শহরের মাসদাইর শ্মশানে তার সৎকার করা হয়। শহরের নয়ামাটি এলাকায় পাঁচতলা দ্বীনবন্ধু মার্কেটের পঞ্চমতলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন দীপক কুমার গোপ ও বিউটি গোপ দম্পতি। তাদের একমাত্র সন্তান ছিল রিয়া। বিয়ের পাঁচ বছর পর এ দম্পতির ঘর আলো করে আসে রিয়া।
রিয়া গোপ ২০১৯ সালে নারায়ণগঞ্জে জন্মগ্রহণ করে। বাবা দীপক গোপ একটি স্থানীয় রড-সিমেন্টের দোকানের ব্যবস্থাপক। মা বিউটি গোপ গৃহিণী। পিতা-মাতার দীর্ঘ পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনের পর রিয়া তাদের একমাত্র সন্তান হিসেবে ঘর আলোকিত করে।
রিয়াদের বাড়ির তিন দিকে বিল্ডিং, শুধু পশ্চিম দিকে খোলা। ফলে ছাদ থেকে ডিআইটি এলাকার গুলশান সিনেমা হল দেখা যায়। ওখান থেকেই গুলি এসে শিশু রিয়ার মাথায় বিদ্ধ হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, আগের সেই বাসায় আর থাকছেন না দীপক কুমার গোপ। মূলত মিডিয়াকে এড়াতেই তারা অন্যত্র সরে গেছেন বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা ও দীপকের আত্মীয়রা। রিয়ার চাচা সম্পর্কের এক ব্যক্তি নিজের নাম বলতে রাজি হননি। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘লিখে আর কী হবে। সব তো শেষ। আমরা এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না। নিজের বাসায়ই তো মানুষ নিরাপদ নয়। ভাইয়ের সব শেষ হয়ে গেছে।’
আলাপকালে তিনি আরও বলেন, রিয়ার বিষয়ে কথা বললে তার ভাবি বিউটি গোপ বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ফলে রিয়ার বিষয়টি নিয়ে তাকে যেন কেউ কিছু না বলে, সে পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। তার পরামর্শেই দীপক ও বিউটি এক আত্মীয়র বাড়িতে অবস্থান করছেন।
এ বিষয়ে মামলা করা হবে কী না জানতে চাইলে রিয়ার চাচা বলেন, ‘মামলা করলে কি রিয়া ফিরে আসবে? এছাড়া তারা কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চান না। এটা ভাইয়ের পরিবারের সিদ্ধান্ত। তারা মিডিয়ার সঙ্গে কথা না বলার এটি অন্যতম কারণ।’
এ সময় রিয়ার চাচা আক্ষেপ করে বলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করার মতো তাদের পরিবারের সক্ষমতা নেই। নেই আর্থিক সংগতি। আজ মামলা করবে কিন্তু সারা জীবন তাদের নিরাপত্তা দেবে কে?’