julymassacrearchive.org

শহীদ আবদুল আহাদ

শিশু

রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ি

মৃত্যু তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪

১৯ জুলাই। সময় বিকেল ৪টা। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় কোটা আন্দোলন নিয়ে চলছে সংঘর্ষ। ৮ তলা বাসার বারান্দায় বাবা-মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে তা দেখছিল চার বছরের ছোট্ট আব্দুল আহাদ। মুহূর্তেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই বারান্দার রেলিং ছেড়ে লুটিয়ে পড়ে আহাদ। বাবা-মা তাকে ধরতেই আঁতকে ওঠেন। দেখতে পান, তাদের সন্তানের ডান চোখ ভেদ করে মাথার ভেতরে কিছু একটা চলে গেছে। এরপর শুরু হয় প্রাণপণে বাঁচানোর চেষ্টা। কিন্তু শেষমেশ সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল সে। 

আব্দুল আহাদ ঢাকার সেগুনবাগিচার কর অঞ্চল-৮ কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী আবুল হাসান ওরফে শান্ত ও (৩৩) সুমি আক্তার দম্পতির ছোট ছেলে। দুই ছেলে দিহান (১১) ও আব্দুল আহাদ (৪) নিয়ে ২০১৯ সাল থেকে রায়েরবাগ এলাকায় ১১ তলার একটি ভবনের ৮ম তলায় ভাড়া বাসায় থাকেন তাঁরা। তাঁদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের পুখুরিয়া গ্রামে। 

আবুল হাসান ওই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত বজলুর রহমানের ছেলে। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনিও সবার ছোট। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যেই চার ভাই সরকারি চাকরিজীবী এবং এক ভাই প্রবাসী। তাঁর ছোট সন্তানের এমন মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরো পরিবারে। 

সবার প্রিয় ছোট্ট এই আহাদকে দিয়েই শুরু হয় তাঁদের পারিবারিক কবরস্থান। বাড়ির উত্তর পাশে বসতঘরের অদূরেই তাঁদের এই কবরস্থানের যাত্রা শুরু হয়। 

আজ শনিবার দুপুরে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে সবার উপস্থিতি থাকলেও এক ধরনের স্তব্ধ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। চাকরির সুবাদে পরিবারের অধিকাংশ সদস্য গ্রামে না থাকলেও সবাই এসেছেন। বাড়িতে ঢুকতেই একে একে জড়ো হলেন আবুল হাসানসহ তাঁর অপর তিন ভাই। এক কোণে বসলেন আব্দুল আহাদের বাবা আবুল হাসান। শুধু নির্বাক হয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন, কোনো কথাই বললেন না। 

এ সময় কথা হয় আবুল হাসানের মেজ ভাই মোখলেছুর রহমানের সঙ্গে। তিনি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সহকারী শিক্ষা অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। 

ছোট ভাইয়ের সন্তানের এমন মৃত্যুতে পরিবার নিয়ে ছুটে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘সবার আদরের ওরে (আহাদ) দিয়েই শুরু হয়েছে আমাদের পারিবারিক কবরস্থান। ১৯৯৮ সালে আমাদের বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের ছোট সদস্যই চলে গেল। এটা আমাদের জন্য কত বড় কষ্টের তা বলে বোঝানো সম্ভব না।’ 

তিনি বলেন, গত শুক্রবার বিকেলে ওদের বাসার নিচে সংঘর্ষ বাধে। তা দেখার জন্য বেলকনিতে যায় ওর বাবা ও মা। সঙ্গে আহাদও যায়। হঠাৎ করে বিকট শব্দ শুনতে পায়। পরে দেখতে পায়, আহাদ লুটিয়ে পড়েছে। ওর মা-বাবা ধরতেই দেখতে পায় ডান চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। দ্রুত নিচে হাসপাতালে নিতে গেলে সেখানেও বাধা দেয় সংঘর্ষকারীরা। পরে আহাদকে রক্তাক্ত দেখে হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। 

তিনি বলেন, ‘খবর পেয়ে ছুটে যাই ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখি আহাদকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। ওর বাবা-মা সামনে বসে কাঁদতেছে। সেখানের চিকিৎসকেরা আহাদকে প্রাণপণে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। অপারেশন করার মতোও অবস্থা ছিল না। কারণ, লাইফ সাপোর্ট থেকে সরালেই মারা যেতে পারে। এভাবেই চিকিৎসা চলে। কিন্তু পরদিন শনিবার রাত ৮টার দিকে চিকিৎসক জানায় আহাদ মারা গেছে।’ 

আহাদের বাবার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, সংঘর্ষের সময় সেখানে কোনো পুলিশ ছিল না। একপাশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা অবস্থান করছিল এবং অপরপাশে আন্দোলন বিরোধীরা অবস্থান করছিল। তাদের মাঝেই দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। হয়তো তাদের মধ্যে থেকেই কারও গুলি লেগেছে। গুলিটি আহাদের ডান চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার ভেতরে চলে যায়। 

ছোট্ট আহাদের মৃতদেহ আনতে ভোগান্তি চার বছরের আহাদের মৃতদেহ আনতেও পদে পদে ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে পরিবারের। আহাদের ছোট্ট দেহের ময়নাতদন্ত করতেও পরিবার রাজি ছিল না। কিন্তু পুলিশ কেস হওয়ায় বাধ্য হয়ে ময়নাতদন্ত করতে রাজি হয়। 

মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘চিকিৎসকেরা জানায় পুলিশ কেস রয়েছে, ময়নাতদন্ত করতে হবে। এ জন্য আমাদের কদমতলী থানায় যেতে বলা হয়। রাতেই কদমতলী থানায় ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, আন্দোলনকারীরা থানা ঘেরাও করে রেখেছে। পরে পুলিশ আমাদের শাহবাগ থানায় পাঠিয়ে দেয়। পরে সেখানে পুলিশের কার্যক্রম শেষে চলে আসি এবং সারা রাত মর্গের সামনেই বসে থাকতে হয় আমাদের। কারণ, সেখানেও সিন্ডিকেট চলছিল। এই সিন্ডিকেটের কারণে লাশ হাতে পেতে পরের দিন বেলা ৩টা বেজে যায়।’ 

তিনি আরও যোগ করেন, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে গেলে ঘটে আরেক বিপত্তি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ভাঙ্গায় আসতে এক একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া চায় ২৫ হাজার টাকা। তখন দুটি অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন ছিল। পরে বাধ্য হয়েই ৩৪ হাজার টাকা দিয়ে দুটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ওর লাশ নিয়ে আসা হয়। পরে পুখুরিয়া রেলস্টেশনের পাশে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। 

এ বিষয়ে শাহবাগ থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে বলে তিনি জানান। তবে, পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মামলা করেননি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top