julymassacrearchive.org

শহীদ সিয়াম সরদার

দোকানকর্মী,

রাব্বানি হোটেল, মিরপুর

মৃত্যু তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪

লেখা: বাসস

দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান সিয়াম। পরিবারের হাল ধরার জন্য কাজ নেন রাজধানী ঢাকার মিরপুর বেনারসি পল্লী এলাকার রাব্বানী হোটেলে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকালে গত ১৮ জুলাই চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে কর্মস্থল এলাকায় প্রাণ হারান তিনি। 

দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে ওই সময়ে শহীদ সিয়াম সরদারকে (১৭) কোনো ধরণের আইনগত ব্যবস্থা ছাড়াই দাফন করা হয় সদর উপজেলার মৈশাদী ইউনিয়নের দক্ষিণ হামনকর্দী গ্রামে। 

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পরিবারের সব স্বপ্ন এখন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সম্প্রতি সরেজমিনে শহীদ সিয়াম সরদারের বাড়িতে গিয়ে তার মৃত্যুর বিষয়ে কথা হয় পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের সাথে।

সিয়ামের সমবয়সী চাচাত ভাই মো. আতিক বলেন, ‘গত ১৮ জুলাই সিয়ামের মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগেও তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। দেশের পরিস্থিতি ভালো নয় বলে আমি তাকে সর্তক থাকার জন্য বলি। সে আমাকে জানায়, এখনো সে ভাত খায়নি। ভাত খেতে হোটেলে যাবে। পরে রাত ১১টার দিকে তার গ্রামের বাড়ি থেকে আমাকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানানো হয়। খবর পেয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখি চোখে গুলি লেগেছে। সেখানে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। পরে হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ এ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়িতে নিয়ে আসি।
তিনি আরও বলেন, পরে সেখানে জানতে পারি ১৮ জুলাই সকালে হোটেলে কাজ শেষে দুপুরে সিয়াম লোকজনের সঙ্গে ছাত্রদের আন্দোলনে যায়। পরে রাতের খাবারের জন্য বাসা থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হয়। সেখান থেকে লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।

জানা গেছে, সিয়াম সরদার তিন ভাই বোনের মধ্যে ছোট। বড় বোন জান্নাত আক্তার (২৪) ও ছোট বোন হাসি আক্তারের (১৯) বিয়ে হয়েছে। তারা স্বামীর বাড়িতে থাকে। 

ঢাকায় কাজে যাওয়ার আগে সিয়াম মা জেসমিন বেগম ও বাবা সোহাগ সরদারের সঙ্গে নিজ বাড়িতে থাকতেন। ছোট বেলায় একবছর স্থানীয় হামানকর্দী দারুল উলুম হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পড়েন। এরপর এলাকার হামানকর্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। সংসারের অভাবের কারণে আর পড়তে পারেননি বলে পরিবারের সদস্যরা জানায়।
সিয়ামের বোন হাসি আক্তার বলেন, ‘মৃত্যুর আগেরদিন রাতে তার সঙ্গে আমার কথা হয়। ওই সময়  আমি তাকে বাড়িতে যাবো বলে জানিয়েছি। সিয়ামও তাকে বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে।’ 

সিয়ামের দাদী লিলু বেগম (৬৫) বলেন, ‘সবাই তাকে খুবই আদর করতো। সিয়াম যখন বাড়িতে ছিলো তাকে বলতাম-আমি যখন মারা যাব তুমি মাটি দিবা। কিন্তু আমার মৃত্যুর আগেই নাতি দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো। আমার নাতি সবার সঙ্গে খুব ভালো আচরণ করতো। তার এই মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের আমি বিচার চাই।’

শহিদ সিয়ামের মা জেসমিন বেগম( ৪২) বলেন, পড়াশুনা না করায় ছেলে আমার সংসারের হাল ধরতে কাজে যায়। ঢাকায় গিয়ে রাব্বানী হোটেলে ২১ দিন চাকরি করে। ২২ দিনের সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। তার সঙ্গে সর্বশেষ আমার কথা হয় ১৬ জুলাই। ঢাকার পরিস্থিতি ভালো না, ছেলেকে সতর্ক থাকার জন্য বলি। সে কাজে আছে বলে আমার ফোন কেটে দেয়। এরপর আবার বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ফোন দেয়। কিন্তু আমি ফোনের কাছে না থাকায় কথা বলতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, দুই মেয়ের বিয়ের পরে ছেলেকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। তারা বাবা কৃষক। সংসারে তেমন আয় রোজগার নেই। ফলে স্বপ্ন ছিল, সেই সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু সেসব স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। ঢাকায় গিয়ে ছেলে আমার মৃত্যুর মুখে পড়বে, এমন জানলে তাকে আমি ঢাকায় পাঠাতাম না। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আমাদের পুরো পরিবার এখন দিশেহারা। আমাদের স্বামী স্ত্রীর বয়স এখন বাড়ছে। সিয়াম ছিল আমাদের একমাত্র সম্বল। আগামী দিনগুলোতে কি করে চলবো আমরা, সেগুলো চিন্তা করলে ঘুমাতে পারি না। সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই। আর কী কারণে আমার ছেলেকে হত্যা করা হলো এবং যারা জড়িত তাদের বিচার চাই। 

সিয়ামের বাবা সোহাগ সরদার (৪৬) জানান, ছেলে ঢাকায় যাওয়ার পর থেকেই তিনি চিন্তিত ছিলেন। যখন ঢাকায় আন্দোলন শুরু হয়, তখন থেকেই ফোনে ছেলেকে সর্তক থাকার জন্য বলেন। তাকে বার বার নিষেধ করা হয় আন্দোলনে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে কারো কথা না শুনে ১৮ জুলাই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হোটেলে কাজ শেষ করে আন্দোলনে যায়। ওই সময়কার আন্দোলনের ছবিও আমরা পেয়েছি। ওই দিন রাত আনুমানিক ১১টার দিকে আমাদের কাছে খবর আসে সিয়াম গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে আমার ভাতিজা আতিক গিয়ে তাকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়।

তিনি বলেন, ‘এ খবর পেয়ে আমরা সবাই ভেঙে পড়ি। তখন ভাতিজা আতিক নিজেই দায়িত্ব নিয়ে পরদিন শুক্রবার সকালে ছেলের লাশ বাড়িতে নিয়ে আসে। ওইদিন বাদজুমআ স্থানীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে নামাজে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।’

সোহাগ সরদার আরও বলেন, আমার ছেলে হত্যার বিচারের জন্য আগস্ট মাসে ঢাকায় কয়েকটি থানায় মামলা করতে যাই। কিন্তু থানা মামলা না নেওয়ায় মিরপুর এলাকার বিএনপি নেতা আমিনুল হকের সহযোগিতায় ঢাকা সিএমএম কোর্টে হত্যা মামলা দায়ের করি। 

তিনি জানান, ছেলের মৃত্যুর পর রাব্বানী হোটেল কর্তৃপক্ষ ১ লাখ টাকা, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। বিএনপি নেতারা বাড়িতে এসে সমবেদনা জানিয়েছেন। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকা এবং কিছু ফল দিয়ে গেছে। এখন সরকারি সহায়তা ছাড়া আমরা কী করে সামনের জীবন পার করবো বলেন। আমরা সবাই চাই সরকার আমাদের দিকে নজর দিক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top