julymassacrearchive.org

শহীদ শাহরিয়ার হোসেন রোকেন

দিনমজুর,

মোহাম্মদপুর

মৃত্যু তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪

প্রতিবেদন: গাফফার খান চৌধুরী

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত রোকনের শহীদি মর্যাদা দাবি করেছেন তার বাবা মনির হোসেন (৫১)। তিনি বলেন, ‘কথায় নয়, কাজে সেটি প্রমাণ করতে হবে। যে সড়কে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছেলে মারা গেছে, ছেলের নামে সেই সড়কের নামকরণ করা হোক। যাতে করে সারাজীবন মানুষ আমার ছেলেকে স্মরণ রাখতে পারে। সরকারের কেউ খবর নেয়নি। সহযোগিতা হিসেবে একটি পয়সাও পাইনি। গুলিতে ছেলের মৃত্যুর পর থানা পুলিশ মামলা নেয়নি। মামলা দায়ের করতে হয়েছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে।’

অনেক খোঁজাখুঁজির পর শেষ পর্যন্ত রোকনের বাসার সন্ধান মিলে। রোকন পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানাধীন পশ্চিম কাঁটাসুরের নামা বাজার এলাকার বছিলা সড়কের ২৫৫ নম্বর হেদায়েত উল্লাহ ওরফে হেদু চৌধুরীর বাড়িতে থাকতেন। দোতলা বাড়িটির দ্বিতীয় তলার একটি টিনশেড ছাউনি দেওয়া ১৩ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৯ ফুট প্রস্থের এক রুমের বাসায় ভাড়ায় থাকতেন। বাড়িটির একাধিক লোকের সঙ্গে কথা বলার পর যোগাযোগ করা সম্ভব হয় রোকনের বাবা মনির হোসেনের সঙ্গে। তার বাসায় বসেই কথা হয় পারিবারিক ও রোকনের বিষয়ে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ভোলা সদরের নাসির মাঝি গ্রামে। নদীতে বাড়ি ঘর ভেঙে যায়। জীবিকার তাগিদে নানা আজিজ ড্রাইভার তার মেয়ে অর্থাৎ আমার মা মনোয়ারা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলায় আসেন। সেটি বহু বছর আগের কথা। আমার মায়ের বয়স তখন আড়াই বছর ছিল বলে মুরুব্বিদের কাছে শুনেছি। আমার পিতা মোতাহার মিয়া। বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। আমাদের জন্ম মোহাম্মদপুরের বছিলাতেই। বিয়ে করি রাবেয়া বেগমকে (৪৫)। আমাদের সংসারে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। সবার বড় ছেলে শাহরিয়ার হোসেন রোকন। দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে নয়ন তারা মীম (২০)। বছরখানেক আগে তাকে বিয়ে দিয়েছি মোহাম্মদপুরেই। অভিষেক নামের এক ছেলের সঙ্গে। জামাই একটি কুরিয়ার সার্ভিসে ডেলিভারিম্যানের চাকরি করে। তৃতীয় সন্তান তামজীদুল ইসলাম (১৮) মোটর গাড়ির গ্যারেজে মেকানিকের কাজ করে। সবার ছোট মেয়ে সানজিদা বেগম (১০)। মোহাম্মদপুরের বরাবর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আমি ডে লেবার বা দিনমজুরের কাজ করি। আমার স্ত্রী গৃহিণী।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘একটি রুমেই আমরা সবাই মিলে থাকতাম। প্রায় ৫ বছর ধরে থাকছি। দুই ছেলে ফ্লোরে ঘুমাত। আমি স্ত্রী আর ছোট মেয়েকে নিয়ে খাটটিতে ঘুমাতাম। রুমটির আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৩ ফুট আর পাশে ৯ ফুট। আসবাবপত্রের মধ্যে একটি স্টিলের ভাঙাচোরা আলমারি, একটি প্লাইউডের পুরনো ওয়্যারড্রপ, রংচটা স্টিলের ড্রয়ার, দেয়ালে ঝুলানো একটি ছোট টেলিভিশন আর একটি বহু পুরাতন ফ্রিজ দেখা গেল। মাসিক সাড়ে ৯ হাজার টাকা ভাড়া। নিজের আর দুই ছেলের রোজগারে কোনোমতে সংসার চলছিল। বড় ছেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ হওয়ার পর সংসারে ব্যাপক টানাপোড়েন চলছে।’

স্বাভাবিক কথাবার্তার একপর্যায়ে আসে রোকনের প্রসঙ্গ। এ সময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘টাকার অভাবে রোকনকে লেখাপড়া করাতে পারিনি। তাই ছেলে সংসারের হাল ধরতে নিজেই কাজ শুরু করেন। ঢাকার চকবাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র কিনে আনত। তাই ফেরি করে বাসে বাসে বিক্রি করত।’

তিনি বলতে থাকেন, ‘ঘটনার দিনটি ছিল চলতি বছরের ১৯ জুলাই শুক্রবার। রোকন অন্যান্য দিনের মতোই ফেরি করে চকোলেট, চিপসসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি করছিল। বেলা ১১টার দিকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে আল্লাহ করিম মসজিদের আশপাশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। রোকনের পরিচিত কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল। তারা শ্রমিক দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ওইদিন অনেক সাধারণ মানুষও অংশ নিয়েছিল। বন্ধু-বান্ধবের দেখাদেখি রোকনও মিছিলে যায়। রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে ছাত্র-জনতা।’

মনির হোসেন বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের হটাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বৃষ্টির মতো গুলি চালাতে থাকে। রোকনের বুকে ও পিঠে শত ছোট ছোট স্টিলের বুলেট বিদ্ধ হয়। পুরো শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ছেলে জীবন বাঁচাতে আল্লাহ করিম মসজিদ থেকে পশ্চিম দিকের ঢাকা রিয়েল এস্টেট গলিতে ঢুকে। একপর্যায়ে দৌড়াতে গিয়ে গলির মুখের ঢালের পশ্চিম দিকের ময়ূর ভিলা নামের বহুতল বাড়িটির সামনের রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। তখন শরীর থেকে স্রোতের মতো রক্ত বইছিল। রাস্তায় পড়ে ছটফট করতে থাকে। এ সময় অনেকেই তার মুখে পানি দেন। একপর্যায়ে বাবা আমার নিস্তেজ হয়ে যায়।’
মোবাইল ফোনে সেই ভিডিও দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতা দ্রুত তাকে শেরেবাংলানগর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে আমরা হাসপাতালে ছুটে যাই।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসকরা তার মুখে অক্সিজেনের মাস্ক পরায়। ২ থেকে ৩ মিনিট পরেই চিকিৎসকরা তার ছেলের মৃত্যুর সংবাদ জানান।’
তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালে থাকা অপরিচিত লোকজনসহ চিকিৎসক ও নার্সরা দ্রুত লাশ নিয়ে যেতে বলেন। অনেকেই তাড়াতাড়ি লাশ নিয়ে যেতে চাপ দিতে থাকেন। কোনো প্রকার পোস্টমর্টেম ছাড়াই লাশ দেয়। সঙ্গে একটি মৃত্যু সনদও দেয়। ছেলের লাশ কাপড় দিয়ে ঢেকে লুকিয়ে নিয়ে যেতে বলেন সেখানে থাকা লোকজন। আমাদের কাছে কাপড় ছিল না। এ সময় একজন নার্স হাসপাতালের শয্যায় বিছানোর বাতিল হওয়া একটি পুরনো নোংরা চাদর দেন। সেই চাদর দিয়ে ছেলের লাশ ঢেকে একটি লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানে তুলি।
এ সময় সেখানকার লোকজন আমাদের বলেন, রাস্তায় কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, ‘এমনিতেই মারা গেছে’। লাশ আনি মোহাম্মদপুরের বাসার পাশেই জান্নাতুল ফেরদাউস জামে মসজিদের সামনে। সেখানেই নামাজে জানাজা হয়। জানাজায় শত শত মানুষ হয়। এরপর লাশ দাফন করি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীন রায়ের বাজার কবরস্থানে।’’

সরকারের কেউ খোঁজখবর নিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, লাশ কবর দেওয়ার জন্য খরচ হওয়া ৫০০ টাকাও কেউ দেয়নি। সহযোগিতা হিসেবে একটি পয়সাও পাইনি। আমাদের খবর নিতে কেউ আসেনি। শুধু শ্রমিক দলের নেতা পরিচয়ে একজন ফোন করে ছেলে সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। শুধু তাই নয়, ছেলে গুলিতে মারা যাওয়ার পর মোহাম্মদপুর থানায় গিয়েছিলাম মামলা করতে। পুলিশ মামলা নেয়নি। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে উকিলের মাধ্যমে ঢাকার সিএমএম আদালতে গিয়ে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করতে হয়েছে।

এ সময় তিনি খাট থেকে নেমে স্টিলের আলমারির একটি ড্রয়ার খুলেন। সেখান থেকে রক্তমাখা একটি গেঞ্জি বের করেন। নিজের বুকের সামনে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘দেখুন আমার ছেলেকে। এই গেঞ্জি গায়ে ছিল গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময়। গেঞ্জিটি গুলিতে শত শত ছিদ্র হয়ে আছে। দেখুন কত গুলি লেগেছে। গুলিতে পুরো গেঞ্জি চালুনির মতো ছিদ্র হয়ে আছে। জার্সির সঙ্গে যে চাদর দিয়ে লাশ ঢেকে এনেছি সেই চাদরও ছেলের স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।’

দেখা গেছে, চাদরের গায়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম লেখা। চাদরটিতে রক্তের দাগ লেগে তা শুকিয়ে আছে। জার্সি আর চাদর বুকে জড়িয়ে পিতা-মাতা আর রোকনের ছোট বোন অঝোরে কাঁদছিলেন।

শহীদ রোকনের পিতা বলেন, ‘আমি ছেলেকে কথায় নয়, সত্যিকারের শহীদের মর্যাদা চাই। কথায় নয়, কাজে সেটি প্রমাণ করতে হবে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর যে সড়কে পড়ে ছেলে মারা গেছে, ছেলের নামে সেই সড়কের নামকরণ করা হোক। যাতে করে সারাজীবন মানুষ আমার ছেলেকে স্মরণ রাখতে পারে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top