julymassacrearchive.org

শহীদ মনসুর মিয়া

সেলসম্যান

বসিলা, ঢাক

মৃত্যু তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪

লেখা: বাসস

অনেক বড় দ্বীনদার আলেম বানানোর স্বপ্ন থেকে মো. মনসুর মিয়া ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন মাদ্রাসায়। বাড়ির কাছেই অক্সফোর্ড মাদ্রাসায় নাজেরা শাখায় পড়ছে তার আদরের শিশু সন্তান মো. মাছরুল ইমাম (১০)। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই একটি বুলেট মনসুরের সব স্বপ্নকে থামিয়ে দেয়। স্ত্রী, সন্তান আর প্রিয়জনদের শোক সাগরে ভাসিয়ে চিরদিনের জন্য ওপারে চলে যায় মনসুর।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন শহীদ মনসুর মিয়ার বড় ভাই মো. আয়নাল হক (৫৪)।

বসিলা মাদবর বাড়ির মৃত আকলাল মিয়ার ছেলে মো. মনসুর মিয়া (৪২) কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই বসিলা ব্রিজের ঢালে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।

তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে শহীদ মো. মনসুর ছিলেন চতুর্থ। ভাইবোনদের ছোট রেখে বাবা-মা গত হয়েছেন অনেক আগেই। বড় ভাই আয়নাল হক ছোট ভাই বোনদের সন্তান স্নেহে বড় করে বিয়ে-শাদি দিয়েছেন। কখনো বাবা-মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। বোনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের ঘরেও এখন নাতি-নাতনি এসেছে। ভাইদেরও বিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিয়েছেন, বলেন আয়নাল হক।

মনসুর বাড়ির কাছেই একটা পেট্রোল পাম্পে সেলসম্যান হিসেবে চাকরি করতেন বলে তিনি জানান।

ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আয়নাল হক বলেন, মনসুর ১৯ জুলাই দুপুর আড়াইটার দিকে ডিউটি থেকে বাসায় এসে গোসল করে। আমার ছোট বোনের বাসায় আমাদের পরিবারের সকলের দাওয়াত ছিল। তাই সেখানে গিয়ে সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে দুপুরের খাবার খাই। এরপর আমি আমার কাজে বাইরে চলে যাই। যাওয়ার সময় ভাইকে বললাম চারদিকের অবস্থা ভালো না, আজকে ভাইয়ের ছেলেকে মাদ্রাসায় দেওয়ার দরকার নেই। পরে বোনের বাসা থেকে তারা বাসায় চলে যায়।

ছেলেকে নিজেই প্রতিদিন মাদ্রাসায় আনা-নেওয়া করতেন মনসুর। ওইদিন বড় ভাই নিষেধ করা সত্ত্বেও ছেলেকে মাদ্রাসায় দেওয়ার উদ্দেশ্যে এলাকার পরিস্থিতি দেখতে ঘরের বাইরে বের হন। বসিলা ব্রিজের কাছে তখন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া আর সংঘর্ষ চলছিল। তিনি যখন ব্রিজের ওপর ওঠেন তখনই কোমরের নিচের দিকে বাম উরুর উপরের অংশে একটি গুলি লাগে, বলেন আয়নাল হক।

তিনি আরও বলেন, আমিও তখন বাইরে বসিলা মেইন রোডে ছিলাম। অসংখ্য শিক্ষার্থী সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমি নিজেও সেদিন সেখান থেকে অনেক শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে রিকশা, গাড়ি করে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছি। এরমধ্যেই খবর পাই আমার ভাই বসিলা ব্রীজের ঢালে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এটা শুনে আমি অচেতন হয়ে যাই। একটু পর নিজেকে সামলে নিয়ে এক প্রকার দৌড়াতে দৌড়াতে ঘটনাস্থলে যাই। আমার সঙ্গে পাড়া প্রতিবেশীরাও যায়।

সেখানে গিয়ে দেখি আমার ভাই অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। রক্তে তার শরীর ও আশপাশ ভেসে যাচ্ছে। আমরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু ভাইকে বাঁচাতে পারিনি। ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আয়নাল হক আক্ষেপ করে বলেন, আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ব্রিজের ওপর থেকে নিজে হেঁটে নিচে নেমে আসে। আশপাশের লোকজনকে ডেকে সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু একজন মানুষও তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। তাকে ঘিরে চতুর্দিকে কেউ ছবি তুলছিল, কেউ ভিডিও করছিল, আবার কেউ ফেসবুকে লাইভ করছিল। এসব না করে কেউ একজন যদি তাকে উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেত এবং সময়মতো রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যেত, তাহলে হয়তো আমার ভাইটিকে আমরা বাঁচাতে পারতাম।

আমাদের কথা বলার মাঝে আয়নাল হকের পাশে এসে বসে মনসুরের ১০ বছরের শিশু সন্তান মাছরুল। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই চোখ ছলছল করে ওঠে। দু’চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। নিরিবিলি বসে থাকে আয়নাল হকের গা ঘেঁষে। মাঝে মাঝেই নীরবে বাবার পরনের কাপড়, ব্যবহৃত জিনিসপত্র বুকে জড়িয়ে বসে থাকেন, এসবের গন্ধ শুঁকে বাবার গায়ের স্পর্শ অনুভবের চেষ্টা করেন। আবার কখনও নিভৃতে কাঁদেন। বাবার মৃত্যুর পর আগের মতো চঞ্চলতা নেই মাছরুলের, মুখে হাসি কমে গেছে, খেলাধুলাও তেমন করেন না মাছরুল, আনমনে কি যেন একটা ভাবেন, বললেন মনসুরের সদ্য বিধবা স্ত্রী রিমা আক্তার (৩০)।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে সন্তানের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে চোখ-মুখে অন্ধকার দেখছেন রিমা। কীভাবে চলবে সামনের দিনগুলো এ নিয়ে অকুল পাথারে পড়েছেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর ভাসুর, দেবরদের আশ্রয়ে আছেন তিনি। তারাই-বা কতদিন দেখবেন। নিজেদেরও তো সংসার আছে। এ ছাড়া স্বামীও তেমন কোনো সম্পদ রেখে যাননি যা দিয়ে সন্তানকে মানুষ করবেন।

রিমা আক্তার জানান, সাভারের বলিয়াপুর গ্রামে তার বাবার বাড়ি। বাবা মৃত. শামসুল হক এবং মা মিনা বেগম (৬০)। নবম শ্রেণী পাস করার পর সংসারের আর্থিক টানাপড়েনে আর পড়াশুনা হয়নি। ২০১২ সালের ১৩ জুলাই বিয়ে হয় মনসুরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থাও ভালো নেই যে সেখানে গিয়ে উঠব বা তাদের সাহায্য নিয়ে সন্তানকে বড় করবো। কিন্তু তার বাবার ইচ্ছে ছিল তিনি তাকে বড় দ্বীনদার আলেম বানাবেন।

শহিদ মনসুরের ইচ্ছে পূরণে তিনি সরকারের সহযোগিতা চান এবং তার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করেন।

মো. মনসুরের হত্যার ঘটনায় ১২ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করা হয়েছে উল্লেখ করে আয়নাল হক জানান, এখনো মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। আমি চাই আমার ভাইয়ের হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের যেনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।

তিনি জানান, এ পর্যন্ত তারা জামায়েতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন।

তবে এ সহযোগিতা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য বলে তিনি উল্লেখ করেন।

শহীদ মো. মনসুর মিয়া ছোটবেলা থেকেই একজন আদর্শবান, পরোপকারী মানুষ ছিলেন। এলাকার মানুষের কাছে একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মানুষের যে কোনো প্রয়োজনে আগে পিছে কিছু না ভেবেই ছুটে যেতেন। সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। এলাকার এমন কোনো মানুষ নেই যে তাকে ভালবাসতেন না, কথাগুলো বলছিলেন মনসুরের প্রতিবেশি ৭০ বছরের বয়োবৃদ্ধ ফজল হক।

এলাকায় তিনি একটা খাবার হোটেল চালান। হোটেলের সামনেই মনসুরের মৃত্যুর প্রতিবাদ জানিয়ে একটি ব্যানার টানিয়েছেন। প্রতিদিন একবার এসে ব্যানারটি দেখেন যেনো কেউ নষ্ট করতে না পারেন, এজন্য হোটেলের কর্মচারি ও আশপাশের লোকদের বলে রেখেছেন।

তিনি বলেন, মাদবর বাড়ির ছেলে মনসুর আমার আত্মীয় বা বংশের কেউ নয়। তবুও সে আমাদের আত্মার আত্মীয়। আমাদের এলাকার রত্ন ছিল। তার ছেলে ও বৌয়ের ভবিষ্যতের জন্য সরকার যেনো একটু দৃষ্টি দেন। এটা সরকারের প্রতি আমার ও এলাকাবাসীর আকুল আবেদন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top