julymassacrearchive.org

শহীদ ফারহান ফাইয়াজ

শিক্ষার্থী,

ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, মোহাম্মদপুর

মৃত্যু তারিখঃ ১৮ জুলাই, ২০২৪

‘পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলের বিষাক্ত ধোঁয়ার ঝাঁজে আমার নাক ও চোখ প্রচণ্ড জ্বলছিল। এ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বড় রাস্তাসংলগ্ন ফুটপাতে আমি বসে পড়লাম। খানিক বাদেই শুনি তুই বুকে গুলি খেয়েছিস। কোনো ঝক্কি-ঝামেলার কথা না ভেবেই তোর কাছে ছুটে গেলাম। এরপর একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তোকে যখন সিটি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ছুটন্ত অ্যাম্বুলেন্সের সিটে শুয়ে থাকা তুই আমার চোখের দিকে তাকালি। আমি দেখলাম, তোর দুই চোখের অব্যক্ত চাহনি! পর পর দু’বার তোর এই চাহনির সময় মনে হচ্ছিল দু’চোখের মণি ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তোর চোখের ওই চাহনিতে ছিল পতিত স্বৈরাচারের সশস্ত্র গুন্ডা বাহিনীর প্রতি একরাশ ঘৃণা। হঠাৎ তোর চোখের দুই পাতা ওঠা-নামা করে বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে! সে সময় আমার ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। বিমূঢ় আমি কাঁদতে চেয়েও পারিনি। তোর চিরবিদায়ের পর, গত তিন সপ্তাহ ধরে ঘুমাতে পারছি না। কারণ, ঘুম ঘুম ভাব এলেই তোর চোখের অব্যক্ত ওই চাহনি স্বপ্নের মধ্যে ভেসে ওঠে, ঘুমাতে দেয় না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে হৃদয় বিদারক এ কথাগুলো বলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে (পরবর্তীতে বৈষম্যবিরোধী) নিহত শহীদ ফারহান ফাইয়াজের সহপাঠী ওয়াসিফ মুনিম। আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন ফারহান ফাইয়াজ। গত ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে সহপাঠীদের সঙ্গে রাস্তায় নামেন ফারহান ফাইয়াজ ও ওয়াসিফ মুনিম। তারা ধানমন্ডি এলাকায় পৌঁছালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে পড়েন। এ সময় ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র এইচএসসি পরীক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ গুলিবিদ্ধ হন। সামান্য আহত হলেও বেঁচে যান ফারহান ফাইয়াজের সহপাঠী ওয়াসিফ মুনিম। ফারহান ফাইয়াজের মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। ওয়াসিফ মুনিম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে গুলিবিদ্ধ ফাইয়াজ সম্পর্কে লেখেন, ‘তোকে প্রথমে আমি ইমার্জেন্সিতে নেই, পরে ডাক্তার জানান, তোকে আইসিইউতে নেওয়া লাগবে। এ সময়ই লিফটে তোর সঙ্গে আমার জীবনের শেষ দেখা, আমাকে আইসিইউতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমার অবস্থা দেখে সবাই মিথ্যা আশ্বাস দিলো, তুই বেঁচে আছিস। হ্যাঁ রে, তুই তো বেঁচে রইলি কোটি মানুষের হৃদয়ে, আর রেখে গেলি তোর চোখের চাহনির স্মৃতি, যা আমাকে প্রতিদিন মারে।’ ওয়াসিফ মুনিম বলেন, ‘আমাকে রাজপথে থাকার অনুপ্রেরণা দিয়ে গেলি। এরপর থেকে এক দিনের জন্যও আন্দোলনে যোগ দেওয়া মিস করিনি। হাতে ছররা গুলি খেয়েও না। তোর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি হতে দেইনিরে ফারহান। তুই জিতে গেছিস রে, আজ তোর দেশ স্বাধীন।’ শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভুঁইয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘বাবার কাঁধে ছেলের লাশ, সন্তান হারানোর শোক, এটা পৃথিবীতে কেউ বুঝবে না। এর চেয়ে ভারী কোনো কিছু আর নেই। একমাত্র যিনি সন্তানকে চিরতরে হারিয়েছেন, তিনিই শুধু সন্তান হারানোর কষ্ট বুঝতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের পুরো নাম মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভুঁইয়া। ডাক নাম রাতুল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে সরকারি বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে শহীদ হওয়ার পর ফারহান ফাইয়াজ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ছোটবেলা থেকে ফারহান শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশে থাকতে পছন্দ করতো। যেখানে ঝগড়াঝাঁটি ও ঝামেলা থাকতো, সেই জায়গা এড়িয়ে চলতো। যে ছেলে সামান্য কষ্ট সহ্য করতে পারতো না, রোদ-বৃষ্টি হলে ছাতা ব্যবহার করতো, কখনো উবার কল করা না হলে লোকাল বাসে চড়ে কলেজে যাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে কষ্ট পেতো, সেই ছেলে কীভাবে এত বড় আন্দোলনে যাবে? আমি চিন্তাই করতে পারি নাই!’ তিনি আরও বলেন, ‘আজকালকার ছেলেদের ফেসবুক বা অন্য সামাজিক মাধ্যমে অবাধ বিচরণ, কেউ কেউ হয়তোবা তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বন্ধুদের গ্রুপে ডাক পড়েছিল, কলেজের একজন শিক্ষকও আন্দোলনে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের আগস্ট মাসের বেতন ফ্রি করে দেওয়ার কথা বলেছিল। ফারহান কোটা সংস্কার আন্দোলনে এতোটাই জড়িয়ে যায় যে, বাসায় তার নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া বোনকে পর্যন্ত বলেছিল, ‘এই ফারিন, তুমি আন্দোলনে যাচ্ছো না কেন? তোমার তো আন্দোলনে যাওয়া উচিত।’ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘ফারহান শিশু বয়সেই তার প্রখর মেধা আর বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছিল। অল্প পড়াতেই সব তার আয়ত্তে এসে যেত। সে তার কলেজের পাঠ্যবই পড়ার পাশাপাশি অন্য সবার চেয়ে প্রতিযোগিতায় নিজেকে একটু এগিয়ে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বইগুলোও পড়তো। তার পড়ার টেবিলে পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন লেখকদের বই সাজানো রয়েছে। ফারহানকে নিয়ে আমরা আশাবাদী ছিলাম। শহীদুল ইসলাম ভুঁইয়া জানান, ফারহানের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে পদার্থবিদ হবে, দেশের বাইরে থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে মানুষের কল্যাণে নিজেকে সম্পৃক্ত করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যেসব পাঠ্যবই ছিল, সেসব বই এখনই সে পড়তো। ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স নিয়ে ধারণা নিয়েছে। সে বলতো, তার কোয়ালিটি এপ্রুভ করার জন্য বুয়েটে অ্যাডমিশন পরীক্ষা দিয়ে তার কোয়ালিটি যাচাই-বাছাই করবে, তারপর ইউকে’তে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যাবে। এটা তার ড্রিম প্রজেক্ট ছিল। এ সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘ফারহান পিৎজা, পাস্তা আর বার্গার খেতে খুব পছন্দ করতো। মৃত্যুর আগের রাতে ১৭ জুলাই অনলাইনে পিৎজা অর্ডার করেছিল। আমি দরজা খুলে সেটা গ্রহণ করি এবং ওর হাতে দেই। খাবার খেয়ে রাত ১০টা বা সাড়ে দশটা নাগাদ শুতে চলে যায়। আর কথা হয়নি, বাবাটার সঙ্গে আবার। অনেক ব্যথা অনেক কষ্ট আমাদের। দেশের জন্য আমাদের একমাত্র ছেলে শহীদ হয়েছে। তার ত্যাগের বিনিময়ে এই বাংলাদেশটা নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। এটা একদিকে আমাদের জন্য যেমন সান্ত্বনার, তেমনি বেদনারও।’ 

লেখা: বাসস

তথ্যসূত্র: সমকাল

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top