julymassacrearchive.org

শহীদ খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ

শিক্ষার্থী,

ইম্পেরিয়াল কলেজ, ঢাকা

মৃত্যু তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪

খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ। পরিবারের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন খালিদ। তার ইচ্ছা ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। আন্তঃস্কুল ক্রিকেট খেলায় চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পুলিশের ছোড়া বুলেটে সেই স্বপ্ন মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়। কথাগুলো শহীদ সাইফুল্লাহর বাবা কামরুল হাসানের। খবর বাসস

তিনি বলেন, ‘প্রচণ্ড মিশুক ছিল খালিদ। খালিদ আমাদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। আন্তঃস্কুল ক্রিকেট খেলায় সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ক্রিকেট খেলা তার অনেক পছন্দের ছিল। ভালো ব্যাটিং করত। তার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে ক্রিকেটার হওয়ার, কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হলো না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম শহীদ খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ (১৭)। তিনি রাজধানীর ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজে একাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে আজিমপুর সরকারি আবাসিক এলাকার ৭ নং ভবনের সামনে ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে খালিদ গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ ২০০৮ সালের ২৯ মে রাজধানীর লালবাগের আমলিগোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কামরুল হাসান (৪৮) মাদ্রাসার শিক্ষক। পাশাপাশি তিনি হোমিও চিকিৎসকও।

বড় ছেলে হারানোর বেদনায় শোকে পাথর হয়ে গেছেন বাবা। তার মুখে তেমন কোনো কথা নেই। সাড়ে ৩ মাস চলে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারেননি তিনি। পরিবারের অন্য সদস্যদেরও একই অবস্থা।

কামরুল হাসান জানান, আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই খালিদ সক্রিয় ছিল। কিন্তু সেদিন আজিমপুর ছাপড়া মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে লালবাগের আমলিগোলার বাসা থেকে বের হয়েছিলেন খালিদ। বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে নামাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। এসময় আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করে আজিমপুর কোয়ার্টারে ঢুকে গুলি চালায় পুলিশ। খালিদ গুলিবিদ্ধ হয়ে। শটগানের অন্তত ৭০টি ছররা গুলি লাগে খালিদের শরীরে। অথচ এলাকাটি সংরক্ষিত।

কামরুল হাসান বলেন, ‘সাইফুল্লাহ মাকে আসরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার কথা বলে বের হয়ে যায়। কিন্তু রাত ১১টায় চেম্বার শেষ করে বাসায় আসার পর ওর মা বলে নামাজ শেষ করে এখনো বাসায় ফেরে নি সাইফুল্লাহ। আমি ওর মোবাইলে ফোন করি। অপরিচিত একজন ফোন ধরে আমাকে আমলিগোলা মক্কা হোটেলের সামনে যেতে বলে। সেখানে গেলে ছেলের মোবাইল হাতে দেয় আমাকে। এমন কী আমার ছেলের নামও ওরা জানত না। ওরা আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে আমরা মর্গে যাই।’

মর্গে অনেকগুলো লাশ দেখতে পান কামরুল। সেখানেই নিজের ছেলের দেহ শনাক্ত করেন কামরুল হাসান।

কামরুল হাসান বলেন- নির্মম, নির্দয় ও পাষাণের মতো আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়।

তিনি আরও বলেন, প্রথমে স্থানীয় সংসদ সদস্য সোলায়মান সেলিমের নির্দেশে তার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আমার সন্তানের মাথায় গুলি করে। তারপর স্থানীয় কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মানিকের নির্দেশে ৬/৭ জন পুলিশ দৌড়ে এসে ২ থেকে ৩ ফুট দূর থেকে খালিদের বুকে ও পেটে ৭০ টি গুলি করে। পুলিশ একটু সরে গেলে ছাত্ররা যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল তখন ইরফান সেলিম ও কয়েকজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাধা দেয়। এ সময়ে খালিদের প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। একপর্যায়ে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সাইফুল্লাহর বাবা বলেন, ‘গত ১৮ জুলাই খালিদ নিহত হওয়ার সংবাদ শোনার পর থেকে আমরা একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সব আত্মীয় স্বজন চলে যাওয়ার পর আমরা এখন অনেক অসহায় বোধ করছি। মনে হচ্ছে, আমাদের ছেলের সঙ্গে আমাদের শরীরের শক্তিও শেষ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড দুর্বল অবস্থায় আছি আমরা।’

সন্তান হারানোর বেদনার পাশাপাশি ওই সময়ের আরও তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে খালিদের বাবা আরও বলেন, কান্না করব, বুক ফেটে আসছিল। তারও কোনো উপায় ছিল না। ছেলের মরদেহ পাওয়া নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম আমরা। ১৮ তারিখ রাত থেকে বাসা, থানা, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ ঘোরাঘুরি করে আমার ছেলের মরদেহ হাতে পাই ২১ জুলাই। পরে ২২ তারিখ ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার সোড়ইবাড়ি কবরস্থানে তাকে দাফন করি।

তিনি বলেন, মর্গে যখন প্রথম তাকে আমি দেখি কীভাবে বোঝাব আমি সেটা, কী হয়েছিল ভেতরে আমার। ৭০টা সিসার ফুটো তার শরীরে। এতটুকু ছোট ছেলে আমার। খালিদের মা রাতে যখন আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল ‘আমার ছেলেকে নিয়া আসছেন তো?’ এর উত্তর আমি কী দিতে পারতাম? খালিদের মা, বোন কান্নাকাটি করে করে প্রায় মূর্ছা যাচ্ছিল। তাদের সান্ত¡না দিতে গিয়ে আমি নিজের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছিলাম না কোনোভাবেই। আমাকে শক্ত থাকতে হয়েছিল। ছেলেটা ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। আর কী বলব আমি ছেলের কথা আমার। এতটুকু বলব শুধু আমার ছেলে শহীদ হয়েছে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের জাতীয় ভাবে শহীদের মর্যাদা দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, আমি চাই প্রত্যেক শহীদের পরিবার ১ কোটি করে টাকা করে পাক এবং তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হোক।

এদিকে খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় তার বাবা কামরুল হাসান গত ১৯ আগস্ট লালবাগ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সংসদ সদস্য হাজি সেলিমসহ ৫২ জনকে আসামি করা হয়

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top