julymassacrearchive.org

শহিদ সালাহউদ্দিন সুমন

চাকরিজীবী (সিনিয়র সেলসম্যান)

মুন্নু সাইনপুকুর বনানী শাখা

মৃত্যুর স্থান: দক্ষিণ বনশ্রী কাজীবাড়ি জামে মসজিদ, ঢাকা

মৃত্যুর তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪

প্রতিবেদন : সুলতান মাহমুদ ও শরিফুল ইসলাম

বাইরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলছিল। বিকালে আমি বাসায় শুয়ে ছিলাম। সে (সালউদ্দিন সুমন) বাইরে যাচ্ছিল। আমি বাইরে যেতে নিষেধ করি। সে আমাকে এই একটু আসছি বলে বাসা থেকে বের হয়। প্রায় ২০ মিনিট পরে আমাকে ফোন করে বলে, ছেলেকে বাইরে যেতে দিও না, বাইরের অবস্থা ভালো না। 

গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বিকাল ৪ টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে এবং পরে এসব কথা হয় স্ত্রী ফাতেমা আক্তার তমার সাথে।

শহিদ সালাউদ্দিন সুমন (৫৪)মুন্নু সাইনপুকুর বনানী শাখার সিনিয়র সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন। চাকুরিতে দায়িত্ব পালনের পর প্রায় প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ঢাকার বনশ্রী এর আশপাশসহ বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় এলাকায় তার ছিল সরব উপস্থিতি। রাজপথে থেকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছিলেন আকণ্ঠ প্রতিবাদী তিনি । ঢাকার খিলগাঁও ১নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন। ঢাকায় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে সুমন ডিউটি শেষে, কখনো কাজের ফাঁকে আন্দোলনে চলে যেতেন। 

গত ১৯ জুলাই বাসা থেকে বের হয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেন সুমন। দক্ষিণ বনশ্রী কাজীবাড়ি জামে মসজিদের সামনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে মুগদা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তাকে পরে দক্ষিণ বনশ্রী এলাকার সুলতানপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ওইদিন বাসা থেকে বের হওয়ার পর সালাউদ্দিন সুমনকে খোঁজাখুজি করতে থাকেন তার স্ত্রী। মোবাইল ফোনের নেট বন্ধ থাকায় পরিবারের লোকজনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি।বাসার আশেপাশের এলাকায় ও চায়ের দোকানে পিতার খোঁজ নিতে বের হয় কলেজপড়ুয়া ছেলে আদিব রেহান।তার একমাত্র ছেলে আদমজি ক্যান্টনমেন্ট কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

শহিদ সালাউদ্দিন সুমনের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার তমা বলেন, ছেলে আদিব রেহান তার বাবাকে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে জানায় সে তার এক বন্ধুর বাসায় যেতে চায়। ছেলেকে বাইরে যেতে নিষেধ করে নিজে বাইরে যায়। এর পর লাশ হয়ে ফেরে।

সে প্রসঙ্গে স্ত্রী ফাতেমা আক্তার তমা(৪৫) বলেন,‘ছেলে বাবাকে না পেয়ে বাসায় ফিরে আসার পর আমি ছেলেকে সাথে নিয়ে ফের খুঁজতে বের হই।তখন বাইরে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এতটাই বেগবান ছিল যে তা বানচাল করতে পুলিশের সাথে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ,ছাত্রলীগ এক হয়ে গুলি চালাচ্ছে এবং ধারালো দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করছে।

এ পরিস্থিতিতে আমার স্বামীর পরিচিত লোকজন আমাকে বাইরে দেখে দ্রুত বাসায় ফিরে যেতে বলেন।তখন বাসায় চলে আসি।’

কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি আরো বলেন, অজানা আশংকায় বাসায় অবস্থানকালে সন্ধ্যা ৭টার দিকে অচেনা নম্বর থেকে ফোনকলে আমাকে দুই-চারজন লোক নিয়ে দ্রুত মুগদা হাসপাতালে যেতে বলা হয়। তখনো ভাবতে পারিনি আমার স্বামী মারা গেছেন। আমি কান্না করতে করতে পাগলের মতো মুগদা হাসপাতালে গিয়ে দেখি গুলিবিদ্ধ স্বামীর নিথর দেহ হাসপাতালে পড়ে আছে।

তমা আরও জানান, বিএনপিকে তিনি মনপ্রাণ দিয়ে এতটাই ভালোবাসতেন সব সময় ছিল দল নিয়ে আলোচনা। প্রায় প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত টিভিতে টকশো দেখে ঘুমাতেন।

তমা বলেন, ‘আমাকে তিনি প্রায়ই বলতেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে একদিন ঠিকই পালাবে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের পতন হবে, দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হবে।তার জীবনের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, কিন্তু তিনি দেখে যেতে পারলেন না। আমার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যাকারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের বিচার চাই।’

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম শহিদ সুমনকে হারিয়ে বড়ো অসহায় এখন তার পরিবার। পরিবারে শুধুই অন্ধকার আর অজানা শংকা। কলেজপড়ুয়া একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে অজানা আশংকায় দিন কাটাচ্ছেন শহিদ সুুমনের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার তমা। এতিম সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে প্রশাসনসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি।

ছেলেকে আর্মি অফিসার বানানোর স্বপ্ন ছিল সুমনের। সেলক্ষ্যেই একমাত্র ছেলে আদিব রেহান ২০২৩ সালে জিপিএ-৫ নিয়ে এসএসসি পাশ করার পর তাকে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি করেছিলেন তার পিতা। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ তিনি আর পেলেন না।

সুমন আদরের ছেলেকে প্রতিদিন কলেজে মোটরসাইকেলে করে পৌঁছে দিতেন। সুমনের মোটরসাইকেলটি স্মৃতি হিসেবে বাসার নিচতলায় রাখা থাকলেও এখন ছেলে বাসে করে দেড়-দুই ঘন্টা সময় পার করে কলেজে যায়। ছেলের পড়ালেখা, সংসারের যাবতীয় খরচ চলতো স্বামীর আয় দিয়ে। 

স্ত্রী তমা বলেন, ‘আমার স্বামীর মৃত্যুতে আমার সুন্দর পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা জানি না আমাদের সামনের দিনগুলো কিভাবে চলবে! যারা আমার একমাত্র সন্তান আদিবকে এতিম করলো আল্লাহ তাদের বিচার করবে’।

তিনি আরও জানান, স্বামী বেঁচে থাকাকালীন যে প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতেন সেই প্রতিষ্ঠান থেকে ছেলের পড়াশোনার খরচ বাবদ দেয়া মাসিক ১০হাজার টাকা এবং আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তায় তাদের কোনরকমে দিন চলছে।

স্বামী মারা যাওয়ার পর বিএনপির পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা, জামায়াতের পক্ষ থেকে এক লক্ষ টাকা এবং আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে ১লাখ টাকা সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়েছে।

ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রী ২নং জামে মসজিদের সামনে কাজী বাড়ি রোড এলাকার বাসায় কাঁদতে কাঁদতে তমা বলেন, ‘স্বৈরাচারী সরকার আমার স্বামীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করলো। স্বামীকে হারানোর পর ভীষণ কষ্টে আছি। কে আয় রোজগার করে পরিবারের হাল ধরবে? ছেলেকে মানুষ করবে?’ 

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শিয়েরবর গ্রামের শামসুদ্দিন মোল্যা ও সামসুন নাহারের ছয় সন্তানের মধ্যে শহিদ সালউদ্দিন সুমন চতুর্থ।

সুমনের সাথে মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের আবুল বাশার মোল্যা ও মাহমুদা খাতুনের মেয়ে ফাতেমা আক্তার তমার বিয়ে হয়।

চাকুরির সুবাদে সুমন পরিবার নিয়ে দক্ষিণ বনশ্রীতে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন।

তীব্র শোকে আচ্ছন্ন সুমনের স্ত্রী বলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে কোনভাবেই ভুলতে পারছি না। আমি আমার স্বামীর স্মৃতিতেই ডুবে আছি। আমি তার হত্যার বিচার চাই।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top