julymassacrearchive.org

শহিদ সবুজ

নৈশপ্রহরী

বড়বাজার লোহাপট্টি

কুষ্টিয়া 

মৃত্যু তারিখঃ ৫ আগস্ট, ২০২৪

প্রতিবেদন : আব্দুর রাজ্জাক বাচ্চু

সবুজ নৈশপ্রহরীর কাজ করতেন কুষ্টিয়া বড়বাজারের লোহাপট্টিতে। তিনি কুষ্টিয়া পৌরসভার ১০নং ওয়ার্ডের চর আমলাপাড়া এলাকার মৃত মো: আব্দুল হান্নানের ছেলে। অভাবের সংসার। তবু বিধবা মা, স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল তাদের।

কিন্তু মো: সবুজ (৩১) পরিবারের কথা চিন্তা না করে সবকিছু ছেড়ে মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেয়। 

গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে সারাদেশের মতো কুষ্টিয়ায়ও আনন্দ মিছিল করে ছাত্র-জনতা। মিছিল শেষে বাড়ি ফেরার পথে শহরের আমলাপাড়ায় ওঁৎ পেতে থাকা আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সবুজসহ বেশ কয়েজনের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। এতে সবুজ গুরুতর আহত হন। পরে ঐদিনই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এ হামলায় আহত হয় আরো কয়েকজন। সবুজ নিহত হওয়ার ঘটনায় স্ত্রী রেশমা খাতুন (২৫) বাদী হয়ে ২২ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এদিকে সবুজের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে  তার পরিবারে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। পরিবারের একমাত্র উপার্জন করা মানুষকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে তার পরিবার। পিতার সান্নিধ্য বুঝার আগেই অনিশ্চিত হয়ে যায় ছয় মাস বয়সী শিশু ছেলে মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ও ছয় বছর বয়সী মেয়ে উম্মে হামজার ভবিষ্যৎ। 

বর্তমানে স্থানীয় ও নিকট স্বজনদের সহযোগিতায় কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে তারা। ঘটনার পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও শোকের মাতম কাটেনি পরিবারটির। বিধবা বৃদ্ধা মা সেলিনা খাতুনের (৭০) এই শোকে ও কান্নায় সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা নেই কারো। আর স্বামীকে হারানোর পাশাপাশি দুই সন্তানের ভবিষ্যত নিয়েও দিশেহারা সবুজের স্ত্রী রেশমা খাতুন।

ঘটনার দিন সবুজের সাথে থাকা এবং একই ঘটনায় আহত সজিব বিশ্বাস রাজা বলেন, গত ৫ আগষ্ট বিজয় উল্লাস শেষে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। ফেরার পথে ৪ নং পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে আসলে আওয়ামী লীগ নেতা ও সন্ত্রাসী বাবুল এবং আক্তারের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী আমাদের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। তাদের এলোপাতাড়ি হামলায় সবুজ গুরুতর আহত হয়। আমিও আহত হই। 

তিনি আরো বলেন, মানুষ যে মানুষের ওপর এমনভাবে হামলা করতে পারে আক্রান্ত না হলে বুঝতাম না। এ সময় তিনি সবুজ হত্যা ও তার সহযোগিদের ওপর হামলায় জড়িত সকলের কঠোর বিচারের দাবি জানান।

নিহতের স্বজনেরা জানান, সবুজের অভাবের সংসার। বড়বাজারের লোহাপট্টিতে নৈশপ্রহরীর কাজ করে চলতো তার সংসার। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করলেও অল্প বয়সে বাবা হারানো সবুজ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুখেই ছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী সরকারের পতনের আনন্দ পরিবারের সাথে ভাগ করে নিতে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে প্রথমে আহত ও পরে নিহত হয় সে। এখন পরিবারটিতে উপার্জন করার মতো আর কেউ নাই।

সবুজের মা সেলিনা খাতুন কান্না জড়িত কণ্ঠে বাসসকে বলেন, ‘মায়ের সামনে ছেলের লাশ এটা যে কত কষ্টের তা শুধু একজন সন্তানহারা মা জানে। পাঁচ মাস হয়ে গেলেও আমার ছেলে সবুজ হত্যার আসামিরা গ্রেফতার হয়নি। আমার মতো আর কেউ যেন সন্তান হারা না হয়। আমি আমার ছেলের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তি দেখে মরতে চাই।

শহিদ মো: সবুজের স্ত্রী হত্যা মামলার বাদী রেশমা খাতুন বাসসকে বলেন, ‘আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল আমার স্বামী। বৃদ্ধা শাশুড়ী ও দুই সন্তান নিয়ে আমি  এখন দিশেহারা। আমার নিরাপরাধ স্বামীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে শহর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক বাবুল ওরফে বান্টা বাবুল ও আক্তারের নেতৃত্বে আওয়ামী-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। এ হত্যার বিচার করতে হবে। ঘটনায় জড়িতদের ফাঁসি দিতে হবে। তাহলে আমার স্বামীর আত্মা শান্তি পাবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।’

তিনি আরো বলেন, আমি মামলার এজহারে যাদের নাম দিয়ে ছিলাম অদৃশ্য কারণে তাদের অনেকের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই। 

এ সময় তিনি আরো বলেন, আমার বৃদ্ধা শাশুড়ী ও এতিম দুই সন্তান নিয়ে যেন চলতে পারি সে বিষয়ে বর্তমান সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই।

এদিকে মৃত্যুর পর জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পরিবারটি কিছু পায়নি বলে জানা গেছে। এছাড়া সরকারি ভাবে এখন পর্যন্ত কোন সহযোগিতাও পায়নি সবুজের পরিবার। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top