শিক্ষার্থী
সরকারি তুলারাম কলেজ, নারায়ণগঞ্জ
মৃত্যু তারিখঃ ৫ আগস্ট, ২০২৪

প্রতিবেদন: আবদুস সালাম আজাদ
আবদুর রহমান শেষবার যখন বাড়ি এসেছিলেন, তখন মায়ের কাছে তার কতো শতো স্বপ্নের কথা বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের কোন সুযোগই পেলেন না তিনি।
মায়ের কাছে এখন ছেলের এসব স্বপ্নই দুঃস্বপ্ন হয়ে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি শোকে কাতর হয়ে ছেলের স্বপ্নের কথা ভেবে কাতর দিন কাটাচ্ছেন।
বলছিলাম শহিদ আবদুর রহমানের কথা। তিনি চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদি দক্ষিণ ইউনিয়নের মাস্টার বাজার এলাকার পিংড়া গ্রামের গাজী বাড়ির প্রবাসী মালেক গাজীর ছেলে।
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত চাঁদপুরে পড়াশুনা করলেও স্নাতক পড়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ চলে যান তিনি। ভর্তি হন সরকারি তোলারাম কলেজে। গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বিজয় মিছিলে গিয়ে রাজধানীর শ্যামপুর এলাকায় দুপুর ১টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন তিনি।
আবদুর রহমান(২২) যখনই বাড়িতে আসতেন মায়ের সাথে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে গল্প করতেন। স্বপ্নের কথা বলতেন। বাবা প্রবাসী হওয়ার কারণে মায়ের কাছেই ছিলো তার সকল আবদার।
সম্প্রতি শহিদ আবদুর রহমানের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় স্বজনদের সাথে। রহমানের বাবা মালেক গাজী দীর্ঘদিন ধরে সৌদি প্রবাসী। ছেলে শহিদ হওয়ার কথা জেনেও কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কায় দেশে আসতে পারেননি।
স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আবদুর রহমানরা দুই ভাই এবং দুই বোন। সবার বড় বোন পান্না বেগম (২৬)। তার বিয়ে হয়েছে। বোন জামাতা মো. শাহানুর বকাউল। তিনি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক মৌচাক শাখায় অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। দ্বিতীয় শহিদ আবদুর রহমান। তৃতীয় আব্দুল্লাহ (১৬) স্থানীয় দিঘলদী মাদ্রাসায় নবম শ্রেণিতে পড়ে এবং চতুর্থ বোন জান্নাত। বয়স আট বছর। স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী।
আবদুর রহমান পিংড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি, হযরত শাহজালাল উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি এবং চাঁদপুর জেলা শহরের বাবুরহাট স্কুল ও কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর স্নাতক শ্রেণিতে পড়ার জন্য চলে যান নারায়ণগঞ্জ। সেখানে শ্যামপুর বোনের বাসায় থেকে নারায়গঞ্জ সরকারি তুলারাম কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করছিলেন।
আবদুর রহমানের ফুফাত ভাই মো. হানিফ মিজি বলেন, ‘আমি নিজেও ঢাকায় থাকি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু জানতাম না আবদুর রহমানও আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিল। সে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমরা জানতে পেরেছি। শেখ হাসিনার পতনের পর যাত্রাবাড়ি এলাকায় বিজয় মিছিলে গিয়ে রহমান গুলিবিদ্ধ হয়। তবে সে পরিবারের কাউকে মিছিলে যাওয়ার কথা জানায়নি।’
আবদুর রহমানের বোন জামাতা শাহানুর বকাউল বলেন, দেশের অবস্থা উত্তপ্ত থাকার কারণে ওই দিন আমি নিজ বাসায় ছিলাম। আবদুর রহমান কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমাদের বাসায় বেশি থাকতো। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট দুপুরে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে সে যাত্রাবাড়ি থানার বিপরীত এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়। তার বুকে কলেজের আইডি কার্ড ছেদ করে গুলি ঢুকে যায়।
তিনি বলেন, ওইদিন দুপুরে কিছু লোক আমাদের বাসার নীচে আসেন এবং আবদুর রহমানের বাসা কোনটি খোঁজ করেন। ওই সময় বাসার গেট বন্ধ ছিলো। আমি নিজে গিয়ে লোকজনের সাথে কথা বলি।
তারা বলেন, আমরা ফেসবুকে দেখেছি আবদুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে তার মরদেহ পাই। তার বুকে গুলি বিদ্ধ হয়ে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর তার সহপাঠীরা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, গত ৫ আগস্টের পর আমরা ফেসবুকে একাধিক ভিডিওতে দেখেছি ওই সময় পুলিশ কিভাবে গুলি চালিয়েছে এবং অনেকেই তখন শহিদ হয়েছে।
শাহানুর বকাউল বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রাতেই তার মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। পরদিন ৬ আগস্ট বাড়িতে নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে আবদুর রহমানেক দাফন করা হয়। তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন ছোট ভাই মো. আবদুল্লাহ।
আবদুর রহমান খুব অমায়িক বন্ধুবৎসল ছিল। সে খুব মিশুক ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আবদুর রহমানের মৃত্যুর পরে তার বাবুরহাট কলেজের সহপাঠীরা এই হত্যার বিচারের দাবিতে মিছিল করেছে। এছাড়া বাবুরহাট-পেন্নাই সড়কের মাথাকে ‘শহিদ আবদুর রহমান চত্বর’ নামকরণ করা হয়েছে।
আবদুর রহমানের বোন পান্না বেগম বলেন, ৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে রহমান বাসা থেকে বের হয়। তবে সে মিছিলে যাবে এমন কিছু বলেনি। আমি তাকে বার বার সতর্ক করেছি ভাই তুমি কোন মিছিলে যাবে না। কিন্তু আমার কথায় সে কান দেয়নি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বেশিরভাগ সময় আমার কাছে থেকেছে।
ভাইয়ের বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন পান্না।
শহিদ আবদুর রহমানের মা পরাভীন ছেলের স্মৃতি ও গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হওয়া কথা বলতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তিনি বলেন, ‘শহিদ হওয়ার প্রায় ১৫ দিন আগে আমার সাথে সর্বশেষ কথা হয়। আমাকে রহমান বলেছে মা আমি বাড়িতে আসবো। তোমাদের বাজার করে দিয়ে যাব। তার বাবাই তাকে বলেছে বাড়িতে আসার জন্য। কিন্তু ছেলে বাড়িতে এসেছে আল্লাহর মেহমান হয়ে।’